Friday, February 26, 2010

ভিস্তি

ভিস্তি এক লুপ্তপ্রায় পেশা।

কালো চামড়ার বালিশের মত 'মশক' ভরে যারা জল দিয়ে যেত তাদের বলা হত ভিস্তি, অনেকে আবার ভিস্তিওয়ালা বলে থাকেন। বিংশ শতকের প্রথম কয়েক দশক পর্য্যন্ত এই ব্যবসার প্রচলন ছিল। বর্ত্তমানে এই পেশা বিলুপ্তপ্রায়। এক কালে যুদ্ধের সময় সৈন্যরা ভিস্তিতে জল রাখত। ব্রিটিশদেরও যুদ্ধ ক্ষেত্রেও দুর্গের মধ্যে খাবার জলের জন্য একমাত্র ভরসা ছিল ভিস্তি। ঢাকায় যে টমটম গাড়ি চলত, তাতেও থাকত জল ভর্ত্তি মশক। এই মশক সাধারণত ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরী হত। মশক তৈরী করার জন্য লাগত বিশেষ দক্ষতা। ভিস্তিওয়ালারা কলকাতায় এক মশক জল বিক্রি করত ১০ থেকে ২০ টাকায়। অনেকে এই জল রান্না ও স্নানের জন্য ব্যবহার করতেন। শোনা যায়, ১৯৪০-৫০ সাল পর্য্যন্ত কলকাতার কিছু পথ, যেখানে ভূগর্ভ গঙ্গাজলের নল ছিল না, সেখানে ভিস্তির জল দিয়ে রাস্তা ধোয়ান হত।


ভিস্তিরা সাহিত্যে বেশ বিখ্যাত।
লাখোবার যায় যদি সে          যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?
ভেবে তাই পাই নে দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?''
 কথাটা যেমনি বলা           রোগা এক ভিস্তিওলা 
ঢিপ্ 'রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দু'পায় তার
- নেড়া বেলতলায় যায় 'বার? / আবোল তাবোল / সুকুমার রায়

তখন বেগে ছুটিল ঝাকে ঝাক
মশক কাখে একুশ লাখ ভিস্তি।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাক,
নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।
- জুতা আবিষ্কার/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। ... কালো মোষের পেটের মতো ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পেতলের কলসের ভেতর। মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি, আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা। ... একদিন পানির কল এলো আমাদের মাহুতটুলীর বাড়িতে। আর সেই সঙ্গে বিদায় নিল ভিস্তি।'' - বাংলাদেশী কবি শামসুর রহমান বাদশা হুমায়ুন নাকি যুদ্ধের ময়দান থেকে একবার পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এক ভিস্তি তাকে জল খাইয়ে এবং তাকে পালাতে সাহায্য করেছিল। বাদশা হুমায়ুন তার ইচ্ছার কথা শুনতে চান। ভিস্তি সিংহাসনে বসতে চান। বাদশা হুমায়ুন তাকে প্রতিশ্রুতি দেন। পরে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক এক ভিস্তিকে একদিনের জন্য রাজ সিংহাসনে বসান।
এছাড়াও আছে রুডইয়ার্ড কিপলিং সাহেব লিখিত 'গঙ্গা দীন'
এখন কলকাতা শহরে একটাই ভিস্তি পড়ে আছে, সেটা বেশ শক্ত পোক্ত, আশা করা যায় বেশ কিছুদিন থাকবে। এটা আছে City Centre, Salt Lake-এর সামনে।



জানিনা কোন পুরোনো বাড়িতে চামড়ার ভিস্তির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে কি না।

আজকাল যারা বোতলে করে mineral water সরবরাহ করে তাদের ভিস্তিওয়ালা বলা যাবে?

1 comment:

  1. সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত পেশার মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন রাস্তার-আলো জ্বালানো-নেভানোর লোকেদের আর দেখা যায়না। এই লেখাটা পড়ে আমার বহু পুরনো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটা ছবি মনে পড়ে গেল। মরক্কোর রাস্তায় এরকম খাবার জল বিক্রি করা মানুষেরা ঘুরে বেড়ান, তাঁদের পিঠে থাকে পাইপ-কল লাগানো মশক, আর গলায় ঝোলানো থাকে চকচকে পেতলের বাটি। সে ছবিটা না পাওয়া গেলেও তাদের ছবি অনেক আছে। তবে কলকাতার ভিস্তিদের মতন তারাও হয়ত আর বেশিদিন নেই।

    ReplyDelete